ভারতের প্রাচীন পুরাণসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে রেখেছে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এবং অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থসমূহ। এসব গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণের লীলার যে বর্ণনা রয়েছে, তা যুগে যুগে ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো কংস বধের কাহিনি। আজ আমরা জানবো, কীভাবে অত্যাচারী রাজা কংসের পতন হয়েছিল এবং শ্রীকৃষ্ণ কেমন করে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কংসের জন্ম ও উত্থান
কংস ছিলেন মথুরার অত্যাচারী রাজা। তিনি ছিলেন রাজা উগ্রসেনের পুত্র। জন্ম থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত বলশালী ও নির্দয়। ক্ষমতা লাভের পর তিনি অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেন এবং নিজের পিতাকে বন্দী করে সিংহাসনে বসেন।
একদিন কংসের বোন দেবকীর বিবাহ সম্পন্ন হয় যদুবংশীয় বসুদেবের সঙ্গে। বোনের প্রতি তার ভালোবাসা থাকলেও, বিয়ের দিনই ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা।
দুর্ভাগ্যসূচক দৈববাণী
দেবকীর বিয়ের সময় এক দৈববাণী হয়—
“হে কংস! দেবকীর অষ্টম সন্তানই তোমার মৃত্যুর কারণ হবে।”
এই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে কংস প্রচণ্ড রেগে যান এবং তৎক্ষণাৎ দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হন। কিন্তু বসুদেব কংসকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, দেবকীর প্রতিটি সন্তান কংসের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কংস এই শর্ত মেনে নেন এবং দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে বন্দী করে রাখেন।
শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব
দেবকীর প্রথম ছয় সন্তান কংস নিজ হাতে হত্যা করেন। সপ্তম সন্তান, বলরাম দেবী যোগমায়ার কৃপায় বসুদেবের অন্য স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে স্থানান্তরিত হন।
অষ্টম সন্তান হিসেবে ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তখন অদ্ভুত এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে—
কারাগারের দ্বার আপনা থেকেই খুলে যায়, রক্ষীরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বসুদেব তখন সদ্যজাত শিশুটিকে নিয়ে যমুনা নদী পার হয়ে গোকুলে যান এবং নন্দ ও যশোদার গৃহে রেখে আসেন। পরিবর্তে যশোদার কন্যা শিশুটিকে নিয়ে এসে কারাগারে রেখে দেন।
কংস ও কৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ
যখন কংস খবর পেলেন যে, দেবকীর অষ্টম সন্তান জন্ম নিয়েছে, তিনি শিশুটিকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু তখনই সেই শিশু রূপ পরিবর্তন করে দেবী যোগমায়ায় পরিণত হন এবং কংসকে সতর্ক করেন—
“হে কংস! তোমার মৃত্যু অবধারিত। যিনি তোমার বিনাশ ঘটাবেন, তিনি ইতোমধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন!”
এই কথা শুনে কংস আরও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন এবং মথুরা জুড়ে শিশু হত্যার আদেশ দেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ গোকুলে নিরাপদেই বেড়ে ওঠেন।
কংসের প্রেরিত রাক্ষসদের বিনাশ
কংস নিশ্চিত ছিলেন যে, তার মৃত্যুর কারণ জন্ম নিয়েছে। তাই তিনি একের পর এক দানব প্রেরণ করতে থাকেন শ্রীকৃষ্ণকে হত্যার জন্য।
১. পূতনা: পূতনা নামে এক রাক্ষসী কংসের আদেশে শিশুরূপী কৃষ্ণকে বিষাক্ত স্তন্যপান করাতে চেয়েছিল। কিন্তু কৃষ্ণ তার প্রাণ শোষণ করে তাকে ধ্বংস করেন।
২. শকটাসুর: শকটাসুর এক দৈত্য, যাকে রথের আকারে পাঠানো হয়েছিল কৃষ্ণকে পিষে মারার জন্য। কিন্তু শিশু কৃষ্ণ সহজেই তার বিনাশ করেন।
3. ত্রিণাবর্ত: এক শক্তিশালী দানব, যে ঝড়ের রূপ ধারণ করে কৃষ্ণকে আকাশে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু কৃষ্ণ তাকে হত্যা করেন।
কৃষ্ণের মথুরা গমন ও কংস বধ
যখন কৃষ্ণ কৈশোরে উপনীত হলেন, তখন তিনি ও বলরাম মথুরায় ফিরে আসেন। কংস তখন এক বৃহৎ যুদ্ধ আয়োজন করেন যেখানে তার চাণুর, মুষ্টিক, কোশল এবং অন্যান্য বলশালী যোদ্ধারা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
কৃষ্ণ ও বলরাম সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং একে একে সব মহাযোদ্ধাকে পরাজিত করেন। শেষে কৃষ্ণ রাজসভায় প্রবেশ করে কংসের সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যান।
এক মুহূর্তের মধ্যে কৃষ্ণ কংসকে টেনে নামান এবং তার বুকে লাফিয়ে পড়েন। সেই আঘাতে কংস মৃত্যুবরণ করেন, এবং মথুরার জনগণ আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ে।
কংস পতনের পরবর্তী ঘটনা
কংসের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ তার পিতামাতা বসুদেব ও দেবকীকে মুক্ত করেন এবং উগ্রসেনকে আবার মথুরার সিংহাসনে বসান।
কৃষ্ণের এই কাহিনি শুধু পৌরাণিক ইতিহাস নয়, এটি ধর্ম, ন্যায় এবং অধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক। কংস ছিল অন্যায়ের প্রতিমূর্তি, আর কৃষ্ণ ছিলেন ন্যায়ের অবতার।
আজও শ্রীকৃষ্ণের এই কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সত্য ও ধর্ম কখনোই পরাজিত হয় না। অন্যায় যত শক্তিশালী হোক না কেন, তার পতন অবশ্যম্ভাবী।
এইভাবেই শ্রীকৃষ্ণ তাঁর লীলায় কংসের অত্যাচার থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করেছিলেন। এই কাহিনি যুগে যুগে ভক্তদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
জয় শ্রীকৃষ্ণ! 🙏