মহারাজ ভগীরথ ও গঙ্গা নদীর পৃথিবীতে আবির্ভাব

ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ও পুরাণে গঙ্গার আবির্ভাব এক মহিমান্বিত ঘটনা। গঙ্গাকে শুধু একটি নদী নয়, বরং স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নামানো এক পবিত্র শক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। এর পেছনে রয়েছে মহারাজ ভগীরথের কঠোর তপস্যা ও এক মহান উদ্দেশ্যের কাহিনি। আজ আমরা জানবো, কীভাবে গঙ্গা স্বর্গ থেকে নেমে এলেন এবং মহাদেব শিব কীভাবে তাঁকে ধারণ করলেন।


সগর রাজা ও তাঁর ষাট হাজার পুত্র

কাহিনিটি শুরু হয় রাজা সগরের সময় থেকে। রাজা সগর ছিলেন অযোধ্যার এক পরাক্রান্ত শাসক। তিনি একসময় অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করার সংকল্প করেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের নিয়ম অনুযায়ী, এক ঘোড়াকে মুক্ত করে দেওয়া হয়, এবং যে রাজ্যের মধ্য দিয়ে সেই ঘোড়া যায়, সেই রাজা যদি চ্যালেঞ্জ না জানায়, তবে তাকে পরাজিত বলে গণ্য করা হয়।

কিন্তু অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে—রাজা সগরের যজ্ঞের ঘোড়া হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়।

মহারাজ ভগীরথ ও গঙ্গা নদীর পৃথিবীতে আবির্ভাব

অনুসন্ধানে জানা যায় যে, সেই ঘোড়া মহর্ষি কপিলের আশ্রমের কাছে অবস্থান করছে। রাজা সগর তখন তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে পাঠান ঘোড়ার সন্ধানে।

মহার্ষি কপিলের ক্রোধ ও সগর পুত্রদের বিনাশ

রাজা সগরের পুত্রগণ মহর্ষি কপিলের আশ্রমে পৌঁছানোর পর ভুল করে ধারণা করেন যে, মহর্ষি ঘোড়াটি চুরি করেছেন। তাঁরা কপিল মুনিকে অপমান করতে উদ্যত হন।

এতে কপিল মুনি রুষ্ট হন এবং ক্রোধাগ্নিতে রাজা সগরের ষাট হাজার পুত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

কিন্তু তাঁদের আত্মারা মুক্তি পায়নি, কারণ তাঁদের যথাযথ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়নি। ফলে তাঁদের আত্মা প্রেত হয়ে থেকে যায়।

মহারাজ ভগীরথের তপস্যা

বহু বছর পর, রাজা সগরের এক বংশধর মহারাজ ভগীরথ জন্ম নেন। তিনি জানতে পারেন যে, তাঁর পূর্বপুরুষদের আত্মা মুক্তির জন্য গঙ্গার পবিত্র জলে তাঁদের অস্থি বিসর্জন দেওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু গঙ্গা তখন স্বর্গে অবস্থান করছিলেন। তাই মহারাজ ভগীরথ কঠোর তপস্যা শুরু করেন এবং ব্রহ্মদেবকে প্রসন্ন করেন।

গঙ্গার পৃথিবীতে আগমন ও শিবের জটায় ধারণ

ব্রহ্মদেব মহারাজ ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে গঙ্গাকে পৃথিবীতে আসার অনুমতি দেন। কিন্তু এক সমস্যা দেখা দেয়—গঙ্গা যদি সরাসরি পৃথিবীতে নেমে আসেন, তবে তাঁর প্রবল স্রোতে ধ্বংস নেমে আসবে।

মহারাজ ভগীরথ ও গঙ্গা নদীর পৃথিবীতে আবির্ভাব

তখন মহাদেব শিব এই প্রবল স্রোত ধারণ করতে সম্মত হন। তিনি তাঁর জটাজালে গঙ্গার প্রবাহ আটকে দেন এবং ধীরে ধীরে গঙ্গাকে মুক্ত করেন, যাতে পৃথিবীতে তিনি শান্তভাবে প্রবাহিত হতে পারেন।

গঙ্গার প্রবাহ ও পূর্বপুরুষদের মুক্তি

শিবের জটা থেকে বেরিয়ে গঙ্গা ভগীরথকে অনুসরণ করেন। পথ চলতে চলতে তিনি বিভিন্ন স্থানে প্রবাহিত হন এবং অবশেষে কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছান।

গঙ্গার পবিত্র জলে সগর পুত্রদের আত্মা মুক্তি পায় এবং স্বর্গে গমন করে।


গঙ্গার পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য

এই কাহিনি প্রমাণ করে যে, গঙ্গা শুধু একটি নদী নয়, বরং স্বর্গ থেকে আগত এক দেবী, যিনি মোক্ষ প্রদান করেন। তাই ভারতীয় সংস্কৃতিতে গঙ্গাকে অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞান করা হয়।

আজও গঙ্গার জলকে “গঙ্গাজল” বলা হয় এবং এটি পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, গঙ্গায় স্নান করলে পাপ মুক্তি ঘটে এবং আত্মা মোক্ষ লাভ করে।


উপসংহার

মহারাজ ভগীরথের অবিরাম প্রচেষ্টা ও তপস্যার ফলেই গঙ্গার পৃথিবীতে আগমন ঘটে। তাই আজও কঠোর প্রচেষ্টা ও ধৈর্যের জন্য “ভগীরথ প্রচেষ্টা” কথাটি একটি জনপ্রিয় উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এই কাহিনি আমাদের শেখায় যে, সংকল্প, অধ্যবসায় এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে অসাধ্যও সাধন করা সম্ভব। গঙ্গা শুধুই এক নদী নন, তিনি এক আশীর্বাদ।

জয় গঙ্গা মাইয়া! 🙏

Spiritual Insights